NewsBar24-Tips-news For You

বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক , ফানি ভিডিও , ভাইরাল সংবাদ , বিনদন সংবাদ এবং অন্যান্য বিষয়ক টিপস এবং বিজ্ঞান এর সংবাদ দেয়া হবে শুধু আপনাদের জন্য। আশা করি আপনারা উপকৃত হবেন

Friday, October 27, 2017

আওকিগাহারা: আত্মহত্যার দুঃখমাখা এক জঙ্গল

আওকিগাহারা: আত্মহত্যার দুঃখমাখা এক জঙ্গল




প্রশান্ত মহাসাগরকে বুকে নিয়ে জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর ও ওখোৎস্ক সাগরের পাড় ঘেঁষে অবস্থিত পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র ‘নিপ্পন-কোকু’ বা ‘দ্য ল্যান্ড অফ রাইজিং সান’, সারা বিশ্বে যেটি পরিচিত জাপান নামে। জাপানে যেমন ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জ, তেমনি আছে হাজারো পর্বতশৃঙ্গ। আজকের লেখা যে জায়গাটি নিয়ে, সেটির অবস্থান জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ফুজি পর্বতমালার পাদদেশে। এই পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিমে একটি রহস্যঘেরা জঙ্গল রয়েছে যার নাম ‘আওকিগাহারা’; এর আয়তন ৩৫ বর্গ কিলোমিটারেরওবেশি। স্থানীয়রা একে ‘সি অফ ট্রিজ’ বা গাছের সমুদ্র নামেও অভিহিত করে থাকে। একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক কারণে অনেক মানুষের শেষ গন্তব্যস্থল রয়েছে এই আওকিগাহারা বনটি; সেটি হলো আত্মহত্যা।
জাপানের আত্মহত্যার জঙ্গল; Source: fromicetospice.com
আগ্নেয় শিলার এই বনে গাছগাছালির কমতি নেই। এখানে রয়েছে সুন্দর আর ভয়ঙ্করের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। জঙ্গলে ঢোকার মুখেই একটু হোঁচট খেতে হয় একটি নোটিশ বোর্ড দেখে। তাতে আছে সুইসাইড প্রিভেনশন অ্যাসোসিয়েশনের একটি সতর্কতামূলক লেখা, যার ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়-
“পিতা-মাতার কাছ থেকে পাওয়া মহামূল্যবান উপহার তোমার এই জীবন। নিজের ভাইবোন ও পরিবারের অন্য সকলের কথা একবার ভাবো। তাদের সঙ্গে তোমার সমস্যাগুলো নিয়ে একটিবার আলোচনা করো। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না।”
জঙ্গলের প্রবেশদ্বারে নির্মিত সাইনবোর্ডটি; Source: odigo.jp
সবুজের সমারোহের এই বনে পা ফেলতেই ধরা দেয় এক ধরনের ভয়ার্ত লোমহর্ষক পরিবেশ। প্রকৃতি আপন মনে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে সুন্দরের বেড়াজালে। অনাকাঙ্ক্ষিত কারো যেন সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই। নিস্তব্ধতা ভঙ্গের দায়ে অযাচিত অনুপ্রবেশকারীদের মনে সঞ্চারিত হয় আত্মহননের চেষ্টা। কোনো অপ্রত্যাশিত অতিথি যেন ঐ বনের কাম্য নয়। বনের মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে বেরিয়ে আসার পথ যেন বন্ধই হয়ে যায়। সবুজের সৌন্দর্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আনন্দে কত শত মানুষই ভিড় করে এই গহীন অরণ্যে। স্থানীয় মানুষ তাই এই বনের নাম শুনলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে। অনেকের মতে অভিশপ্ত এই বন; কারো মতে অলৌকিকতার ছোঁয়া, আবার কারো মতে অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধের মোহ বিরাজ করছে এখানে।
জঙ্গলের ভেতরের ছবি; Source: upload.wikimedia.org
এই বনে আত্মহত্যা শুরুর ইতিহাসটা বেশ পুরনো। ১৯৫০ সাল থেকে হিসেব শুরু হয়ে এখনও পর্যন্ত পাঁচশরও অধিক আত্মহত্যার ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় এই বনে। তবে সবচাইতে বেশি সংখ্যার হিসেব পাওয়া যায় ২০০২ সালে ৭৮টি এবং ২০০৩ সালে ১০৫টি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখনও পর্যন্ত এই সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না।
১৯৬০ সালে জাপানি লেখক সেইচো মাতসুমোতোর ‘কুরোই জুকাই’ নামে একটি উপন্যাস বের হয়। সেই গল্পে প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদের করুণ কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে এই আওকিগাহারা জঙ্গলে। উপন্যাসটি সেই সময় জাপানি সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। প্রেমে ব্যর্থ যুবক-যুবতীরা নিজেদের শেষ করতে আশ্রয় নিতে থাকে এই বনের মাঝে। কয়েকদিন পরই পাওয়া যায় তাদের নিশ্চল দেহ।
কুরোই জুকাই; Source: carlospaezs.wixsite.com
১৯৯৩ সালে আরেক জাপানি লেখক ওয়াতারু তসুরুমুইয়ের ‘দ্য কমপ্লিট সুইসাইড ম্যানুয়াল’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যাঙ্গনে বইটি তখন বেশ বিতর্কিত হয়। কিন্তু সকল বিতর্ক ছাপিয়ে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের স্থান দখল করে নেয় বইটি। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, বইটিতে আত্মহত্যার বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া আছে। বইটিতে আওকিগাহারা বনকে আত্মহত্যার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। একে আত্মহত্যার অনন্য সাধারণ জায়গা হিসেবে তুলে ধরা হয় সেখানে। বইটিতে বলা হয়, সেখানে মৃত্যুবরণের মানে নাকি সবুজের রঙে মিশে গিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতির কাছে সঁপে দেওয়া। এমন লেখায় প্রভাবিত হয়ে অনেকেই এই জঙ্গলে প্রবেশ করে। কেউ গলায় ফাঁসি দিয়ে, কেউ বা পথ হারিয়ে, কেউ না খেতে পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে নিজেদের শেষ করে দেয়। অনেক মৃতদেহের পাশেই পাওয়া যায় তসুরুমুইয়ের বইটি।
দি কমপ্লিট ম্যানুয়াল অফ সুইসাইড; Source: sunsetgrid.bandcamp.com
তবে এই প্রসঙ্গে স্থানীয়দের মাঝে কিছু বিতর্কিত মতামত রয়েছে। তার মধ্যে একটি আবার বেশ পুরনো ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। তাদের মতে, আত্মহত্যা বা ইচ্ছামৃত্যুর শুরু আজ হতে অনেক বছর আগে। সেসময় জাপান এখনকার মতো এত সম্পদশালী ও প্রভাবশালী দেশ ছিল না। দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল জাপানের বিভিন্ন জায়গায়। ফলে অনেক পরিবারেই নেমে আসে নিদারুণ দুর্ভোগ। অনাহারে থাকতে না পেরে পরিবারের লোকেরা একটি করুণ সিদ্ধান্ত নেয়। অনাহারের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হতো এই বনে। যাদের বনে রেখে আসা হতো, তারা স্বাভাবিকভাবেই না খেতে পেয়ে কিছুদিন পর মারা যেত অথবা বনের হিংস্র পশুর শিকার হতো।
তাই স্থানীয়দের ধারণা, অনাহারে কষ্ট পেয়ে মারা যাওয়া এসব দুর্ভাগা মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় এই বনে। বনের ভেতর ঢুকে পড়া মানুষদের নাকি আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে আত্মাগুলো। তবে এই ধারণা অনেকটা অনুমান নির্ভর এবং প্রচলিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের কল্পিত ভাবনা বলেই অনেকে মনে করেন।
গহীন অরণ্য; youtube.com
তবে এই রহস্যময় জঙ্গলকে ঘিরে দেশ বিদেশের মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে এই জঙ্গল ঘুরতে আসেন অসংখ্য মানুষ। অনেকে আবার আসেন ডকুমেন্টারি তৈরি করার জন্য, ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও রয়েছে। ২০১৫ সালে এই জঙ্গলে ‘দ্য সি অফ ট্রিস’ নামে একটি সিনেমার শুটিং হয়। এর ঠিক পরের বছরই জেসন জাডার পরিচালনায় ‘দ্য ফরেস্ট’ নামে আরও একটি মুভি মুক্তি পায়। এই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে লেখা হচ্ছে অনেক বইও।
দি ফরেস্ট মুভির প্রচ্ছদ; Source: horror.land
স্থানীয় কেউ এই জঙ্গলে গাইড হিসেবে যেতে রাজি হয় না। তাই যারা জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করে, তারা এক ধরনের দড়ি গাছের সাথে বেঁধে রেখে যায় চিহ্ন হিসেবে। জঙ্গলের ভেতরে এদিক সেদিক তাঁবুর ভগ্নাংশ, ছেঁড়া কাপড়, দড়ি ইত্যাদির অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এখনও পর্যন্ত আত্মহননের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ঝুলন্ত সেতু ‘দ্য গোল্ডেন গেইট ব্রিজে’র পরেই এর অবস্থান।
দ্য গোল্ডেন গেইট ব্রিজ; P.C: Frank Schulenburg
বর্তমানে জাপান শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ, প্রতিভা সবকিছুতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে বিশ্বের বুকে। কিন্তু তা স্বত্বেও ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক জরিপে দেখানো হয় যে, শুধুমাত্র জাপানেই ২,৬৪৫ জন আত্মহত্যা করে যা পূর্বের বছরের চাইতে পনের শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা নিয়ে জাপানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে শিক্ষক, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞরা বিশেষভাবে চিন্তিত।
জাপানের এই দুঃখী বনের মাঝে দুঃখী কোনো মানুষের এমন অবস্থার কথা চিন্তা করেই হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন,
“শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধু শুয়ে ছিল পাশে-শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল জোছনায় তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয় নি ঘুম বহুকাল- লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।”

No comments:

Post a Comment

>