ভালো লেখায় যেসব বৈশিষ্ট্য না থাকলেই নয়
__________________________________________________________________________
প্রতিটি মানুষের রয়েছে ভাব প্রকাশের নিজস্ব শৈলী, তেমনি প্রতিটি লেখকেরও। একজন মানুষ কীভাবে চিন্তা করেন, কী নিয়ে বেশি ভাবেন এবং তিনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন তা সবই উঠে আসে একজন লেখকের লেখায়। তার পরিপার্শ্ব, জীবন, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান সবকিছুর সমন্বয় ও প্রতিফলনই দেখতে পাওয়া যায় তার লেখায়। ‘ভালো লেখা’ বলতে আমরা কী বুঝি? এর কি কোনো আদর্শ পরিমাপক আছে, কিংবা মাপবার জন্য কোনো সূক্ষ্ম দাঁড়িপাল্লা? না, নেই। লেখক যা বলতে চাচ্ছন তা সুখপাঠ্য চেহারায় পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হওয়াটাই একটি লেখার ‘ভালো লেখা’ হয়ে উঠবার গন্তব্য। কিন্তু এই গন্তব্যে পৌঁছুতে তাকে কী কী পথ পেরোতে হয়, সেগুলোই এখন জেনে নেয়া যাক।
পাঠকের প্রশ্নের উত্তর
একটি লেখা যখন প্রকাশ পাবার উদ্দেশ্যে লেখা হয়, তখন সেটি একেবারে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও পাঠকের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। এটি লেখকের নয়, পাঠকের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়। তবে এজন্য লেখককে নিজেও পাঠক হয়ে উঠতে হয়। তিনি তার লেখাটি পাঠকের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করবেন এবং একজন পাঠক তা পড়ার সময় যে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারেন, তা নির্ধারণ করবেন। লেখাটি পড়বার পর পাঠকমনে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন জাগে, লেখক সেই প্রশ্নগুলো খুঁজে বের করে এর উত্তর লেখার মধ্যেই দিয়ে দেবেন। এতে করে যেকোনো বিষয়ে লেখাটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তথ্যমূলক দিকটি এক্ষেত্রে পরিবেশিত হয়।
এ বিষয়ে জর্জ ওরওয়েল বলেন,
একজন লেখক লিখবার সময় নিজেকে কিছু প্রশ্ন করলে ব্যাপারগুলো তার নিজের কাছেও অনেক বেশি সহজবোধ্য হয়ে যায়। আমি কী বলতে চেষ্টা করছি? বাছাই করা শব্দগুলো কি তা প্রকাশ করতে পুরোপুরি সক্ষম? কোন ধরনের ছবি বা প্রবাদের মধ্য দিয়ে তা সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠবে? এই ছবিটি কি পাঠকের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম? এবং লেখা শেষে আরো দুটো প্রশ্ন লেখককে ভাবিয়ে তোলে, আমি কি চাইলেই লেখাটা আরেকটু ছোট করতে পারতাম? আমি কি অশোভন এমন কিছু লিখেছি যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল?
তথ্যের মধ্য দিয়ে লেখার ভিত্তি স্থাপন
বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে সঠিক তথ্য দেবার মাধ্যমে পাঠকের বিশ্বস্ততা অর্জন করা যায়। তাই প্রথমেই লেখার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে যাচাই-বাছাইকৃত সঠিক তথ্যের মাধ্যমে। রেফারেন্সও দিতে হবে যাতে করে জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে। তথ্য, গবেষণা, যাচাই-বাছাই, পরিশোধিত রূপায়ণ ইত্যাদির মাধ্যমে লেখাটি হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য। শুধুমাত্র লেখকের নিজস্ব মতামতের উপরেই নয়, বরং সত্যতার মধ্যে প্রোথিত লেখা সব পাঠকের কাছেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত। এখানে মূলত ফিকশনের কথা বলা হচ্ছে না, যেখানে কল্পনার রঙ মিশেল দিতে হবে, সেটা হয়তো তথ্যের মুখাপেক্ষী নয়। কিন্তু আপনি যখন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা ব্যক্তি নিয়ে একটি লেখা প্রস্তুত করবেন, এতে বহু তথ্য ও রেফারেন্সের প্রয়োজন আছে। এর বড় একটি কারণ হলো সঠিক তথ্যের মাধ্যমে পাঠকের বিশ্বস্ততা অর্জন। নৈতিকতার দাবিও এর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। একটি লেখা তখনই ভালো লেখা হবে যখন এটি সঠিক তথ্য পরিবেশনে সক্ষম হবে। আপনি যদি লিখতে চান আপনি কী ভাবেন, তবে এর আগে বলে নিন আপনি তা কেন ভাবেন?
অর্থব্যক্তি ও প্রাঞ্জলতা
‘রচনার শিল্পগুণ’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, রচনার দুটি গুণ হচ্ছে অর্থব্যক্তি ও প্রাঞ্জলতা। সঠিক শব্দ সঠিক স্থানে ব্যবহার করা এবং সর্বোপরি সহজবোধ্যতার মাধ্যমেই একটি লেখা সফল বলে বিবেচিত হয়। একটি ভালো লেখার মধ্যে লেখক যা বলতে চাইছেন, তা সর্বাঙ্গীনভাবে ব্যাখ্যা করবেন। যথাযথ যুক্তির মাধ্যমে তার লেখনীকে অন্যের কাছে প্রাঞ্জল করে তুলবেন; শুধু ভাষায় নয়, বোধেও। যা লিখতে যাচ্ছেন তা যেন পাঠকের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়। একটু স্পষ্ট করে ভাব প্রকাশ করতে হয়, যদি এতে গভীর কোনো অর্থ থাকে এবং লেখক যদি হেঁয়ালি পছন্দ করেন, সেটিরও একটি স্পষ্ট নির্দেশ পাঠকের জন্য ছুঁড়ে দিতে হয়।
সম্পূর্ণ বিষয়টি উপস্থাপন
মুদ্রার এক পিঠকে প্রতিনিধিত্ব না করে দুটো দিকেই তাকাবেন লেখক। এবং সেই দুটো দিকের পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি পাঠকের জন্য তৈরি করবেন তার লেখনীতে। নিজের ব্যক্তিগত ভাবের ছাপ প্রবল হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব স্পষ্টভাবে স্বীকার করতে হয় একটি ভালো লেখায়, নইলে সেটি গল্পের পুরোটা বলে না, থেকে যায় অসম্পূর্ণ ও একপেশে। একপেশে লেখাকে কখনো ভালো লেখা বলা যায় না। যদি কোনো লেখায় একটি নির্দিষ্ট অংশের পক্ষ নিয়েও লেখা হয়, সেখানেও প্রতিটি বিষয় ও প্রতিটি পক্ষ আগে বলে নিতে হবে এবং তারপর নিজের পক্ষ উপস্থাপন করতে হবে। এতে করে তথ্যের ভিত্তি স্থাপনও হয়ে যায়।
ভালো লেখা অনেকাংশেই পুনর্লিখিত রূপ
একজন লেখক এক ধাক্কায় প্রথমেই যা লিখে ফেলেন, একেবারে শেষের রূপটি কিন্তু তার চেয়ে অনেক ভিন্নতর গঠনে চলে আসে। পুনর্লিখন, সংযোজন-বিয়োজন, পরিশোধন- এগুলো থাকবেই। সোনা পুড়ে পুড়ে যেভাবে নিখাদ হয়, তেমনি একটি খসড়া লেখাও বারবার বিভিন্ন রূপায়ণের পথ অতিক্রম করে শেষমেশ তার চূড়ান্ত রূপে আসে। যেকোনো সৃষ্টিতেই কিছু ধাপ থাকে। এর মধ্যে প্রথমেই একটি যেমন-তেমন আদল গড়ে নিতে হয়। সেই গড়ে নেয়া আদলে ধীরে ধীরে একটি আকৃতি দেয়া, আকার নিয়ে ভাবা, রঙের মিশেল দেয়া এবং সবশেষে কাটছাঁট! লেখক কেমন লেখা চাইছেন সেই ভিত্তিতে একটা আলাদা শৈলীদানও ভালো লেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
কিছুটা অঙ্কের মতোই এর নিয়ম
দু’দিক দিয়ে একটি ভালো লেখাকে অঙ্কের সাথে তুলনা করা যায়। প্রথমত এতে থাকতে হবে ভালো গঠনশৈলী ও যুক্তি। পাঠকের কাছে তা যেন ফাঁপা বুলি মনে না হয়, সেদিকেও দেখতে হবে। এর গঠনে থাকবে নিরেট ভাব। তবে অঙ্কের মতো এর কোনো নির্দিষ্ট সূত্র নেই যা না মেনে চললে ফলাফল মিলবে না! কিন্তু এতে কিছু পরিমাপের বিষয়ও থাকে। অঙ্ক যেভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠা যায়, ভালো লেখার ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই। তবে অবশ্যই লেখার জন্য স্পৃহা থাকতে হবে, নিজের মানসিক চাহিদা থাকতে হবে, নইলে বহু অনুশীলনেও ভালো লেখা আসবে না!
লেখার আগে পড়া জরুরি
অনেক বই পড়তে হবে। ভাষাশৈলী বা তথ্য সংগ্রহ, যেকোনো দিক দিয়েই বই পড়া একটি ইতিবাচক উপায়। যদি কোনো বিষয়ে লেখার আগে তা নিয়ে লেখা কয়েকটি বই পড়া হয় তবে তা সম্পর্কে অনেক স্পষ্টতা আসবে। ডিজিটালাইজেশনের যুগে এখন বইয়ের পাশাপাশি আছে বহু অনলাইন জার্নালও যার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বহুমাত্রিক তথ্য-উপাত্ত মেলে। সেগুলো থেকেও আপনার লেখাকে সমৃদ্ধতর করা যায়।
ব্যাকরণিক জ্ঞান বৃদ্ধি
একটি লেখা তখনই সুখপাঠ্য যখন এর গঠনে দুর্বলতা থাকে না। একটি লেখার গঠন শক্তিশালী করতে এর ব্যাকরণিক দিকে খেয়াল রাখা অনেক জরুরি। বাক্যের গঠন, বানান, ক্ষেত্রবিশেষে শব্দের অর্থের ভিন্নতা, বিভিন্ন প্রবাদবাক্যের সঠিক স্থানে ব্যবহার, অর্থ না বুঝে কোনো কঠিন শব্দ ব্যবহার না করা ইত্যাদি দিকে দৃষ্টি দিলে ভালো লেখা অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। অনেকেই মনে করেন তিনি যা বলতে চাইছেন তা কোনোমতে লিখে দিতে পারলেই হলো, কিন্তু তা শুধু খোঁড়া অযুহাত বৈ আর কিছু নয়। শুধুমাত্র ব্যাকরণিক ভুল বা গাফিলতির কারণেই অনেকক্ষেত্রে অর্থের অপব্যাখ্যা ঘটে এবং এতে করে লেখার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এসব এড়িয়ে চলবার জন্য লেখককে নিজের ব্যাকরণিক জ্ঞান বৃদ্ধি করতে হবে।
তথ্যসূত্র: রচনার শিল্পগুণ- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment